ক্ষোভ কাটেনি প্রশাসনে

চাকরি অধ্যাদেশ নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের আসছে কঠোর আন্দোলন
দীর্ঘ ১০ দিনের ছুটির পর সচিবালয়সহ দেশের সব সরকারি অফিস খুলছে আজ। বিতর্কিত ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নিয়ে ক্ষোভ নিয়েই পবিত্র ঈদুল আজহা পালন করতে ছুটিতে গিয়েছিলেন সরকারি কর্মচারীরা। কারণ ঈদের আগে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষোভ প্রশমনের কোনো ঘোষণা আসেনি। তাই ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসেও বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বিক্ষোভ করেছিল। তখন নেতারা বলেছিলেন, দাবি না মানলে ঈদের ছুটি শেষে অফিস চালুর পর দীর্ঘ কর্মবিরতিতে যাবেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। এ কর্মসূচিতে দেশের অন্য সব সরকারি অফিসের কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ত করা হবে। তাই আর অপেক্ষা না করে অফিস খোলার প্রথম দিনেই সরকারি কর্মচারীরা চাইছেন নতুন কর্মসূচি। বিক্ষুব্ধ সরকারি কর্মচারীরা চান ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বিকালেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করুক সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।
জানা যায়, চার ধরনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়াই শুধু কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে চাকরিচ্যুত করার বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করায় সংক্ষুব্ধ হন। তাই গত ২৫ মে অধ্যাদেশ জারির পরপরই অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও কালো আইন হিসেবে অবহিত করে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলনে যান। এর আগে খসড়া অনুমোদনের পর থেকেই এটি বাতিল করার জন্য সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় কয়েকজন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপিও দেন। শেষ কর্মদিবসের কর্মসূচি পালনকালে বাংলাদেশ সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবির কর্মচারীদের উদ্দেশে ১৬ জুন প্রস্তুতি নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন কেউ যেন কর্মস্থলে না থাকেন, সবাই যেন বেলা ১১টায় সচিবালয়ের বাদামতলায় উপস্থিত থাকেন।
এদিকে সরকারি কর্মচারীদের টানা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সুচিন্তিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে কমিটির আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আবদুর রশীদ। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম গতকাল বলেন, ঈদের আগে আমরা চেয়েছিলাম আমাদের দাবিটি অর্থাৎ অনুমোদিত অধ্যাদেশটি বাতিল করবে সরকার। সবাই খুশি মনে ঈদ করতে চেয়েছিলাম। সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে এটি ইতিবাচক। ঈদের আগে সরকার উপদেষ্টা কমিটি করেছে। তবে আমাদের কারও সঙ্গে আর এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি বা সরকার থেকেও করেনি। আমাদের দাবি- অধ্যাদেশটি বাতিল না হলে কঠোর আন্দোলন হবে। এ আন্দোলন দলমত নির্বিশেষে সবার। এটি বিভাগ জেলা শহরের সব দপ্তরে ছড়াবে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথম কর্মদিবসে কয়েকজন সচিব ও উপদেষ্টার সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করব এবং প্রথম কর্মদিবসেই বিকালে নতুন কর্মসূচি দেব। সরকার আমাদের দাবি না মানলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।
জানা যায়, ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ সরকারি কর্মচারীদের (আইনানুযায়ী সব সরকারি চাকরিজীবী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী) চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো-সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন; অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম জানায়, এ অধ্যাদেশে বিভাগীয় মামলার পরিবর্তে শুধু একটি লেটার দিয়ে চাকরিচ্যুতি বা দণ্ড দেওয়া যাবে- এই বিধানের ফলে কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তার কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসে পরিণত হবেন। ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে। বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবেন। চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে। অপছন্দ হলে কর্মকর্তার রোষানলে পড়বেন। তাদের মতে, নারী সহকর্মীদের ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশে কাজ করতে হবে। কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণেও চাকরিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এমনকি কেউ কেউ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কারণেও কর্মকর্তার রোষানলে পড়তে পারেন। এতে দেশ ও জাতির সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা এবং বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। কর্মচারীদের ন্যায্যতা-প্রাপ্যতার দাবিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাধার সৃষ্টি করবে ও ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হবে। অবশ্য এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে বলে দুজন উপদেষ্টাও উল্লেখ করেছিলেন।