South east bank ad

সেনা শাসন না, গণতন্ত্রের পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী

 প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন   |   সেনাবাহিনী

সেনা শাসন না, গণতন্ত্রের পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী

বাংলাদেশে ক্ষমতাবান ও নীতিনির্ধারকরা সবাই জনগণের কথা বলেন, কিন্তু জনগণের জন্য কজন কাজ করেন। জনগণের কথা কজন ভাবেন? রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়ে যাঁরা বসে থাকেন, তাঁরা কি জানেন জনগণ কী চায়? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর হবে ‘না’।
এখন যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন তাঁদের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়ছে। জনগণের চাওয়া-পাওয়া তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

এ জন্যই তৈরি হচ্ছে নানা অশান্তি, বিশৃঙ্খলা। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক বাড়ছে। ব্যতিক্রম শুধু সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশে এখন একমাত্র আশার বাতিঘর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী।

তারাই যেন জনগণের প্রত্যাশার কথা বুঝতে পারছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হচ্ছে তাদের কণ্ঠে। সরকার কার্যকর নয়, নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত, সিদ্ধান্তহীনতা সরকারের সব কাজে। দেশজুড়ে আন্দোলন, পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয়, প্রশাসনে অচলাবস্থা।

একটি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হওয়ার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হয় তার একটিও ঠিকঠাকমতো কাজ করছে না। জনগণের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, ক্ষোভ। এই অবস্থার মধ্যে জনগণের আস্থা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি। সেটি হলো আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনী না থাকলে বাংলাদেশে হয়তো এখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী হলো আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। দেশ রক্ষার দায়িত্বে আছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু শুধু দেশ রক্ষা নয়, যেকোনো সংকটে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। পথ দেখিয়েছে। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনার সময়ও আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পেরেছে। সশস্ত্র বাহিনীর কারণেই সে সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পেরেছে। এখন যখন দেশ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে, সাধারণ মানুষ যখন হতাশার গভীরে, ঠিক সেই সময় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী যেন মানুষের প্রত্যাশার বাতিঘর হয়ে সামনে এসেছে। এ দেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করে সেই প্রত্যাশার কথা সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। কদিন আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সুস্পষ্টভাবে কয়েকটি বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন। এটি শুধু সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান ছিল না, এটি ছিল গোটা বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের অবস্থান। গত সোমবার (২৬ মে) সেনা সদরের পক্ষ থেকেও একটা ব্রিফিং করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বক্তব্য দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক সময়ে কার্যক্রম সম্পর্কে সেনা সদরে এই ব্রিফিংটি ছিল নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সেনাপ্রধানের বক্তব্যকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন। গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনীর আপসহীন অবস্থান আবার পুনর্ব্যক্ত করলেন।

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর অনেকেই গুজব ছড়িয়েছিলেন। জনমনে নানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সশস্ত্র বাহিনী আর সরকার কি মুখোমুখি? সরকারের সঙ্গে কি সেনাবাহিনীর কোনো মতপার্থক্য হচ্ছে? সেনাশাসনের গুজবও ছড়ানো হয়েছিল উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে। এ নিয়ে কোনো কোনো মহল দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো বেশ কিছু মন্তব্য করেছিল। এটা পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর বক্তব্য সমর্থন করা হয়। দেশবাসী সেনাপ্রধানের বক্তব্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। গত সোমবার সেনা সদরের ব্রিফিং যেন সব গুজব আর মিথ্যাচারে জল ঢেলে দিল। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিল এই ব্রিফিং। তিনি বললেন, ‘সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো মতবিরোধ নেই। ’

বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ করার নজির রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সশস্ত্র বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণে রাজি না। তারা গণতন্ত্র চায়। সশস্ত্র বাহিনী শুধু চাইছে দেশ স্বাভাবিক হোক। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারা এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। শান্তি, স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেনাশাসন নয়, গণতন্ত্র চায়। এটা আমাদের জন্য গর্বের, অহংকারের। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দ্বিমাত্রিক দায়িত্ব পালন করছে। প্রথমত, তারা দেশের যে অরাজক বিশৃঙ্খল অবস্থা সেখান থেকে গণতন্ত্র উত্তরণের একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বদ্ধপরিকর। বিশ্বে এটি একটি বিরল ঘটনা যে একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনী একসঙ্গে দুটি কাজ সুচারুরূপে দক্ষতার সঙ্গে এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ করতে পারে।

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ এটা এখন প্রমাণিত যে, গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে এই অরাজকতা, বিশৃঙ্খল অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না। সেনাবাহিনী প্রধান শুরু থেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের কথা বারবার বলে আসছেন। সেই বক্তব্যে তিনি এখনো অটল রয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গেও কথা বলেছেন। কাজেই সশস্ত্র বাহিনী সরকারের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে—এমনটি যাঁরা প্রচার করছেন, তাঁরা আসলে বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন অথবা তাঁদের অন্য কোনো মতলব আছে। যাঁরা এক-এগারোর কুশীলব তাঁরা এ রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান। একটি দেশের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বাইরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে দেশে এ রকম অবস্থা চলতে পারে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই, এটি সশস্ত্র বাহিনী যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছে। সে জন্যই সেনাপ্রধান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন। জনগণের প্রত্যাশার কথা বলছেন। এই মুহূর্তে সশস্ত্র বাহিনী আসলে একমাত্র জনগণের রক্ষাকর্তা। তারা ছাড়া কেউই জনগণ এবং দেশের কথা ভাবছে না। রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য এই অবস্থান নেওয়া তাদের দায়িত্ব।

সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ দেশের সন্তান। এ দেশের মাটিতেই তাঁদের বেড়ে ওঠা। কাজেই তাঁরা যেকোনো অভিপ্রায় বা দেশের ব্যাপারে তাঁদের যেকোনো ভাবনা থাকতেই পারে। তাঁদের কৌশল নির্ধারণে এ ধরনের বক্তব্য তাঁরা দিতেই পারেন। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কাজ করছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাজেই জনগণের প্রত্যাশা তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানেন এবং বোঝেন। বিষয়টি এমন নয় যে সেনাপ্রধান এই বক্তব্য নতুন করে দিয়েছেন। তিনি একাধিকবার এই বক্তব্য দিয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাকেই বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই অবস্থান জানানো হয়েছে। কাজেই সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। সেই বিভ্রান্তি দূর করেছে সেনা সদরের ব্রিফিং। সবচেয়ে বড় কথা, জুলাই বিপ্লবের অন্যতম স্টেকহোল্ডার সশস্ত্র বাহিনী। কাজেই রাষ্ট্রের পথনকশা নির্ধারণে তাদের মতামত কেন উপেক্ষা করা হবে?
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো দেশ রক্ষা করা। এই দায়িত্ব পালন করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর যা যা করা দরকার তা করতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে বর্তমানে সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে বেশ কিছু হুমকি দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা এবং শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকার কী করতে যাচ্ছে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আমাদের সেনাপ্রধান তাঁদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের অনুরণন ঘটেছে সেনা সদরের গত সোমবারের ব্রিফিংয়ে। এ ধরনের করিডর আত্মঘাতী হবে বলে অনেকেরই ধারণা। অনেকের মতে, সরকার অদৃশ্য কারো ইশারায় এই ইস্যুটিকে নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলছে। এ বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক, সে রকম স্বচ্ছতা সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।

মব ভায়োলেন্সের ব্যাপারেও সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে, যা সেনাপ্রধানের বক্তব্যের অনুরণন। আমরা দেখি, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর সেনা সদরের ব্রিফিং একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তিনটি বিষয়ে একেবারে ঐক্যবদ্ধ এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। প্রথমত, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, দেশের সার্বভৌমত্ব অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং তৃতীয়ত, কোনো অবস্থাতেই যেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়। মব ভায়োলেন্স এবং যেকোনো নাশকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী সোচ্চার। এই তিনটিই এ দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। এ দেশের মানুষ কথা বলতে পারছে না। তাদের প্রত্যাশার বাতিঘর হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী কাজ করছে। জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হচ্ছে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনী যেন এখন জনগণের কণ্ঠস্বর।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

BBS cable ad

সেনাবাহিনী এর আরও খবর: