South east bank ad

নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর মাঠে থাকা প্রয়োজন

 প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১১ পূর্বাহ্ন   |   মন্ত্রণালয়

নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর মাঠে থাকা প্রয়োজন

দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই-চাঁদাবাজি চলছেই। আবার খুনখারাবি তো আছেই।
দেশের ব্যবসায়ী সমাজ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া সাধারণত মানুষও অশান্তিতে আছে।

এমন অবস্থায় আইন-শঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী মাঠে না থাকলে অবস্থা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করত। সেনাবাহিনী দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ অন্যান্য সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ দমনে সম্পৃক্ত আছে। দেশের সর্বত্রই সেনাবাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক হাজার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে।

সম্প্রতি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে (গত ১৭ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে কনেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশিত দায়িত্বই পালন করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

রাজধানীসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে অবরোধ থাকলে অর্থনীতির সব সেক্টরেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী চেষ্টা করে যত কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অবরোধটাকে মুক্ত করার জন্য। গত দুই মাসে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কিশোর গ্যাং, তালিকাভুক্ত অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী, অপহরণকারী, চোরাচালানকারী, প্রতারক ও দালালচক্র, চাঁদাবাজ, ডাকাত, ছিনতাইকারীরা রয়েছে। অভিযানের সময় সেনাবাহিনী দুই মাসে ৩২০টি অবৈধ অস্ত্র ও ৫৬৪ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।

৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৩৭০টি অবৈধ অস্ত্র ও দুই লাখ ৮৫ হাজার ৫২ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে।

কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম আরও জানান, সেনাবাহিনী গত দুই মাসে ২৩২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ৩৭টি, সরকারি সংস্থা ও অফিস সংক্রান্ত ২৪টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৭৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ছিল ৯৫টি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী অদ্যাবধি চার হাজার ৩৪০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। তাঁদের মধ্যে ৪৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সম্মানে সেনাবাহিনী গত ২৩ মার্চ সেনামালঞ্চে ইফতার ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করে। ২৫ মার্চ আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে আহত এবং শহীদ পরিবারের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান সেখানে উপস্থিত থেকে সবার খোঁজখবর নেন ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

কর্নেল শফিকুল ইসলাম জানান, বিগত সময়ে শিল্পাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনী ১৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ৩১ বার বিভিন্ন মূল সড়ককে অবরোধ থেকে অবমুক্ত করেছে। শিল্পাঞ্চলে জাতীয় নিরাপত্তা বিধানের সময় গত ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রবিন টেক্স গার্মেন্টসে অস্থিরতা প্রশমনকালে কিছু গার্মেন্টস শ্রমিকের ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় ২৪ জন সেনা সদস্য আহত হন। আহতদের মধ্যে ২০ জনকে সিএমএইচে ভর্তি হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গার্মেন্টসে ঈদ-পূর্ব অস্থিরতা মোকাবেলায় সেনাবাহিনী মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, মন্ত্রণালয়, শিল্পাঞ্চল পুলিশ ও বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে বিশেষ ব্যবস্থা করে, যা শ্রমিকদের মাঝে ঈদ-পূর্ববর্তী গতানুগতিক অস্থিরতা প্রশমনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

এই সেনা কর্মকর্তা জানান, ঈদুল ফিতরে ঘরমুখো মানুষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ঈদের আগে ও পরে মিলে দুই সপ্তাহের বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ দেশের সব জেলার বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন এবং লঞ্চ টার্মিনাল ও সড়কে দিনরাত টহল পরিচালনা, স্পর্শকাতর স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। যা মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গত বছরের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পায়। যা জনসাধারণকে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছানোসহ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘনভাবে ঈদ উদযাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

পহেলা বৈশাখ সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে বলেও জানান সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ। তিনি বলেন, যার ফলে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের সব স্তরের জনসাধারণ আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। দেশের চরাঞ্চলসহ ৬২টি জেলায় সেনা সদস্যরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছে।

গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর কয়েকটি কারখানায় আগুনের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবি জানিয়েছিলেন। ঢাকার প্ল্যাটিনাম গ্র্যান্ড হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসি-বি) সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, কারখানা, বিশেষ করে পোশাক কারখানা খুলেছে। কিন্তু অশান্তি ও ভাঙচুরের ভয়ে অনেকে ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও (ডিসিসিআই) দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের আহবান জানিয়েছিল।

জনসাধারণের জান-মাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশব্যাপী স্থাপিত ২০৬টি ক্যাম্পের মাধ্যমে ৫৮টি জেলায় মোতায়েন রয়েছে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দুটি দল জামালপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পলায়নে উদ্যত হওয়া কয়েদিদের বাধা প্রদান এবং কারাগারে রক্ষিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সুরক্ষিত করে। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা প্রতিহত করার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নোয়াখালী জেলার একটি মন্দিরে দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিহত করা হয়। এ ছাড়া কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণকারী মায়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে নিরাপত্তা প্রদানে সেনা সদস্য মোতায়েন হয় এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যৌথ পেট্রোল পরিচালনা করে। রাজধানী ঢাকার ২৯টি থানাসহ দেশজুড়ে ৪১৭টি থানায় এরই মধ্যে সেনা মোতায়ন করা হয়েছে, যা পুলিশের হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার অভিযানকে ত্বরান্বিত করছে। সেই সঙ্গে বঙ্গভবন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, মহাখালী ডেটা সেন্টারসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রচার করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপতৎপরতা চলমান রয়েছে। দেশবাসীকে এ ধরনের গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে সেনাক্যাম্পে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিজের বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়ে। পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়। এই সুযোগে অপরাধ বৃদ্ধি পায়। নানা ধরনের অন্তর্ঘাত শুরু হয়। শিল্পাঞ্চলসহ নানা স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনের কারণে জনজীবনের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হতে থাকে। কখনো কখনো সেসব সহিংসতায় রূপ নেয়। এমন অবস্থায় প্রথম থেকেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি জনজীবনের স্বাভাবিকতা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫০ দিনে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অন্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ছিল। গত সোমবার ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনা সদর আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

BBS cable ad