South east bank ad

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

 প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ০৫:২৮ অপরাহ্ন   |   সম্পাদকীয়

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা

মোস্তাফা জব্বার : 
মুজিব জন্মশতবর্ষে আমি বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে আসছি। সেই ৪৭ সাল থেকে ধাপে ধাপে কেমন করে তিনি বাংলার জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলেন সেটি আলোচনা করার এটিই উত্তম সময়। এই ছোট নিবন্ধটিতে হাতের কাছে পাওয়া দলিলপত্রাদি পর্যালোচনা করে জাতির পিতার অত্যন্ত কার্যকর একটি কর্মসূচী ছয় দফা নিয়ে আলোচনা করছি। ছয় দফা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই কর্মসূচীর হাত ধরেই আমার বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া। ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র হিসেবে প্রথম উপলব্ধি করি পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটিতে তখন বাস করি সেটি আমাদের স্বাধীনতা নয়, দাসত্ব। জাতির পিতার ছয় দফাতেই সেই সচেতনতা তৈরি হয়।

ইতিহাস বলে পূর্ববঙ্গের জনগণ ১৯৪৯ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। ছয় দফা আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার ধারাবাহিক আন্দোলনের একটি প্রাক প্রকাশ্য স্তর মাত্র। ১০ জানুয়ারি ১৯৬৬ পাক- ভারত তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে তাসখন্দ চুক্তি ও শত্রু সম্পত্তি আইনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে অসন্তোষ দানা বাঁধে। সেই প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্থানের বেশ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে লাহোরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল এতে যোগদান করেন। অন্যান্য দল থেকে ১১ জন প্রতিনিধি ঢাকা থেকে যান। তবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০-এর অধিক সদস্য উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় ১০ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা উত্থাপন করে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বার্থকে উর্ধে তুলে ধরেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা ৬ দফা সমর্থন করেননি। সম্মেলনে ৬ দফা আলোচিতও হয়নি।

লাহোরে অনুষ্ঠিত ১০ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফা সম্পর্কে বক্তব্য রেখে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর প্রতিনিধিদল উক্ত সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের নিকট জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের একটি অংশ বিরোধিতা করে। এছাড়া কাউন্সিল মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলাম এবং নেজামে ইসলামও ছয় দফার বিরুদ্ধে সমালোচনা করে বক্তব্য প্রদান করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকার নওয়াবজাদা নসরুল্লাহসহ ৫ জন বিরোধীদলীয় নেতাকে গ্রেফতার করে। ঐদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে ৬ দফার বিষয়বস্তুর ওপর বিশদ ব্যাখ্যা দেন। বস্তুত আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে যে চিন্তা-ভাবনা ও আন্দোলনের সূচনা করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবির মধ্য দিয়ে তা মূর্ত হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের মহান নেতা হিসেবে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এই সময় আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠল। একুশে ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফার সামগ্রিক প্রস্তাবনামা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন লাভ করে। ১৯৬৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় দফা আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহারে পরিণত হয়। এনডিএফ এবং নেজামে ইসলাম ঐক্যজোট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে ২৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাতে সাড়া দেননি। আওয়ামী লীগ উক্ত ৬ দফা গ্রহণ করার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ৬ দফার পক্ষে গণজোয়ার তৈরির প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। খোদ আইয়ুব খান ছয় দফার বিপক্ষে রাস্তায় নামেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ৬ দফা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি প্রদান করেন।

১৬ মার্চ আইয়ুব খান রাজশাহীতে প্রকাশ্যভাবে ৬ দফার সমালোচনা করলেন এবং বললেন, এটা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই একটি পরিকল্পনা। তিনি এর বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন, এই ‘জঘন্য স্বপ্ন’ বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তানবাসী গোলামে পরিণত হবে। তাই এই কাজ তিনি কখনই সফল হতে দেবেন না। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে গৃহযুদ্ধেরও হুমকি প্রদান করেন।

১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৬ দফাকে দলের প্রধান ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকেই আওয়ামী লীগ দলের প্রধান নীতি বলে বিবেচনা করে। ঘটনাক্রমে কাউন্সিল মুসলিম লীগের অধিবেশনও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। বলাবাহুল্য, আইয়ুব খান, মোনায়েম খান প্রকাশ্যে ৬ দফার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐতিহাসিক’ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় ৬ দফার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। কাউন্সিল অধিবেশন বঙ্গবন্ধুকে সভাপতি রেখে একটি নতুন কমিটি গঠন করে। আওয়ামী লীগের নতুন কাউন্সিল অধিবেশন এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন ৬ দফার সংগ্রামকে বেগবান করার উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ৬ দফাকে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জ এবং হুমকিস্বরূপ গ্রহণ করতে থাকে। আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬ দফার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে থাকেন। তেমনিভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সরকারের এসব অপব্যাখ্যা এবং আচরণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দান করেন। আওয়ামী লীগ নতুন ওয়ার্কিং কমিটি সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে ৪ এপ্রিল কমিটি ঘোষণা করে।

আওয়ামী লীগ যখন ছয় দফার প্রচার জোরদার করতে মাঠে নামে (মার্চ-এপ্রিল মাস) সরকারও এর বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মাওলানা ভাসানী ছয় দফার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। তাঁর এই ধরনের বক্তব্য ৮ এপ্রিল একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ভাসানী সাহেব আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক আচরণকে সমর্থন করে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলকে সাম্রাজবাদীদের দালাল বলে গালি দিতেও দ্বিধা করেননি। তিনি ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গেও গোপন সন্ধিতে যোগ দিয়েছিলেন ‘সোহরাওয়ার্দী নিধনযজ্ঞে’।

মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায় হবে। জনগণ ৬ দফাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছে বলে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন। মূলত এটি থেকে স্পষ্ট যে, মওলানা সাহেব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এবং ৬ দফার বিরোধিতা করতে শুরু করেন। এদিকে ন্যাপ নেতা মিঃ মশিউর রহমানও ছয় দফার বিরোধিতা করে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় বিবৃতি দেন।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য উত্তরবঙ্গ সফরে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বের হন। তিনি দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিভিন্ন জেলায় জনসভায় ভাষণ দেন। খুলনায় জনসভা শেষে ঢাকা ফেরার পথে ১৮ এপ্রিল ভোর রাতে যশোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন ৪৭(৫) ধারা বলে গ্রেফতার করে। ঢাকার পল্টন ময়দানে ২০ মার্চ রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেয়ার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যশোরে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে যশোর এসডিও কোর্টে হাজির করা হলে ঢাকার এসডিও কোর্টে হাজির হওয়ার শর্তে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়। ঢাকার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক ১৯৬৬ সালের ৮ মে প্রস্তুতকৃত পত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অভিযোগ এনে তাঁকে তিন মাসের আটকাদেশ প্রদান করে ৯ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। নতুন নতুন অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার ছয় দফার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অনবরত নাজেহাল করার চেষ্টা করতেই থাকে। তাঁকে নিয়ে বরাবরই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল সরকার। দলীয় প্রধান নেতৃবৃন্দ জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩০ মে দলের ছয় দফা বাস্তবায়নের নীতি অব্যাহত রাখা, ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ সময় সরকার আওয়ামী লীগের প্রচারকার্যে বাধা হিসেবে পোস্টার ছাপানোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, কর্মীদের বেআইনীভাবে আটক রাখার কৌশল অবলম্বন করে। মিজানুর রহমান চৌধুরী পত্র-পত্রিকায় সরকারের এ ধরনের বাধার তীব্র সমালোচনা করে একটি বিবৃতি প্রদান করলে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনায়েম খান পাল্টা বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার আন্দোলন ‘কঠোরহস্তে’ দমনের হুমকি প্রদান করেন। ইত্যবসরে ২ জুন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে আওয়ামী লীগের বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সরকার ৭ জুন হরতাল উপলক্ষে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করে পত্র-পত্রিকাসমূহের ওপর অঘোষিতভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করে। বিশেষ করে ইত্তেফাকের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর।

সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আহূত ৭ জুনের হরতাল সম্পর্কে সকল সত্য তথ্য গোপন করে আইয়ুব সরকার পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য বিবরণী প্রচার করে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ঐদিন হরতালে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়েছিল। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন হরতালে এত বেশি সংখ্যক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ছয় দফার কারণে সরকার আওয়ামী লীগের ওপর কতখানি ক্ষিপ্ত ছিল তা ওইদিনের হরতালে সরকারের আচরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ৭ জুন এত বড় হত্যাকান্ড ঘটে গেল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ন্যাপ সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু তার আগে স্বায়ত্তশাসন দাবির বিরুদ্ধে যে দমননীতি ও ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল ন্যাপ নেতৃবৃন্দ তারও সমালোচনা করেননি। এ হরতালের এতটা ব্যাপকতা ছিল যে, এ সম্পর্কে কোন প্রতিবেদন, মুদ্রণ ও প্রকাশের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও মানিক মিয়া তার কলাম লিখেন। ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার এবং দ্য নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াফত করে। ছয় দফা বানচাল করার জন্য আওয়ামী লীগের কোন প্যামফলেট, পোস্টার ছাপাতে দেয়া হয়নি। যে প্রেসই ছাপায় তার মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের ওপর সর্বাত্মক নির্যাতন চলে। এমনকি ছয় দফা বিরোধীদের আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ব্যাপকভাবে মাঠে নামানো হয়। ৭ জুনের হরতালের পর বাঙালী নিশ্চিত হয় যে, এটিই তাদের নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন এবং বঙ্গবন্ধুই তাদের একমাত্র নেতা। এর প্রতিকার হিসেবে পাকিস্তানী শাসকরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে যে, কিছুসংখ্যক সরকারী কর্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৬ জানুয়ারি অপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মাসে পূর্ব পাকিস্তানে জাতিবিরোধী এক পরিকল্পনা উদ্ঘাটিত হয়েছিল এবং সেই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রেসনোটে আরও বলা হয়েছে যে, এদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৮ জানুয়ারি (১৯৬৮) প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, আগরতলা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও সম্পর্ক ছিল। তিনি আগে থেকেই ডিপিআর (ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস) অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন। তবে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে ঢাকা জেলা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা প্রথম কয়েকদিন কেউ জানতে পারেনি। পরবর্তীতে জানা যায় সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত একটার দিকে তোজাম্মেল হোসেন একটি লিখিত আদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন স্যার, আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।’ তবে বঙ্গবন্ধু বাইরের মাটিতে বেশিক্ষণ পা রাখতে পারেননি। জেলগেট থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মিলিটারি ভ্যান সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়াল তাঁর সামনে। তাঁকে বিজাতীয় ভাষায় জানানো হলো, তুমি আবার বন্দী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল বন্দীকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাখা হয়। সামরিক আদালতে বিচারের পরিকল্পনা থেকেই নতুন এই মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বন্দীদের সেনানিবাসে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে ধারণা সম্প্রসারিত হতে থাকে।

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারা ১১ দফা প্রণয়ন করে যার একটি দফা ছিল ৬ দফা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনেই ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি হাজার হাজার সমর্থকের এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। এর আগে পাকিস্তানের কোন জনসমাবেশে এত মানুষ সমবেত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি হয়ে উঠলেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁকে প্রদান করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধি।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক







BBS cable ad