একুশে আগস্ট দেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন
মোঃ ইউছুফ হোসেন, সম্পাদক, বিডিফিন্যান্সিয়াল নিউজ লাইভ .কম লিমিটেড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলে চার জাতীয় নেতার খুনের ঘটনা, ৭ নভেম্বর সেনা কর্মকর্তাদের নিধন ছিল হত্যা ও ষড়যন্ত্রের অপরাজনীতির পরিণতি। ’৯০ সালে দৃশ্যত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও নিষ্ক্রান্ত হয়নি ষড়যন্ত্রের হোতারা। ’৯৬ সালের নির্বাচনে ’৭৫-পরবর্তী ধারার রাজনীতির পরাজয় হয়। ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ দল। কিন্তু ২০০১-এর নির্বাচনের আগে ও পরে বিস্তৃত হয় ষড়যন্ত্রের থাবা। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে আইয়ামে জাহেলিয়ার কসরত চলে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা হত্যার শিকার হন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মতো যশস্বী সংসদবেত্তা অল্পের জন্য বেঁচে যান ঘাতকের হামলা থেকে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর প্রকাশ্য সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় হত্যার চেষ্টা চলে। এ ঘটনায় আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হন। এ হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং আরও বেশি ক্ষমতাধরদের ‘ঠাকুরঘরে কে রে? আমি কলা খাই না’ জাতীয় কর্মকা- ছিল রহস্যজনক। গ্রেনেড হামলার মদদদাতা বলে পরিচিত বিশেষ ভবনের অধীশ্বর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের আড়াল দিতে জজ মিয়া নাটকেরও অবতারণা হয়। ক্ষমতা চিরস্থায়ী ও মুক্তিযুদ্ধের পতাকাবাহীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে কারা জড়িত ছিল তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ২১ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর তা ধামাচাপা দিতে মামলার আলামত লোপাট করার চেষ্টা চলে সরকারিভাবে। তবে মেঘ দিয়ে যেমন সূর্য ঢাকা যায় না তেমন ২১ আগস্টের দুর্বৃত্তদের চেহারা লুকানো সম্ভব হয়নি।
রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী আগস্ট মাস। ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি এই মাসকেই বেছে নিয়েছিল তাদের প্রতিশোধের স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জাতির জনকের সুযোগ্যা কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন, আহত হন দুই শতাধিক নেতাকর্মী। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। ২০০৫ সালেও দেশব্যাপী একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটে।
২১ আগস্টের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটিও ছিল স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে নির্মূল করার আরো একটি অপপ্রয়াস। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার। তদন্তে উঠে এসেছে, হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের উপস্থিতিতে দফায় দফায় বৈঠকে এই হামলার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল। জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদকে (হুজি) হামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। হুজি নেতা মুফতি হান্নান তাঁর জবানবন্দিতে এই পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা লুত্ফুজ্জামান বাবর, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ বিএনপি ও জামায়াতের আরো কিছু নেতা সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই) এবং পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন পরিকল্পনার সঙ্গে। তাই দীর্ঘ সময় ধরে হামলা চালিয়েও হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পেরেছে। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডসহ মামলার আলামতগুলো দ্রুত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত নেতারা একে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলে গলা ফাটাতে থাকে। কেউ কেউ এমনও বলেছে, শেখ হাসিনাই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। তদন্তের নামেও তারা প্রহসন করেছে। জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার একই পরিকল্পনা থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যও একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এর আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার মঞ্চের পাশে ৭০ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের আগেই সেটি ধরা পড়ে যায়। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকে স্বয়ং পুলিশ গুলি চালায়। এতে ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হলেও অল্পের জন্য রক্ষা পান শেখ হাসিনা। ২১ আগস্টের ঘটনাও ছিল সেই ধারাবাহিক পরিকল্পনারই অংশ। এদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আমরা আশা করি, দ্রুত এই মামলার রায় কার্যকর করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর সাহস না করে।
একুশে আগস্ট দেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের হত্যার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে যে এ হামলা চালানো হয় তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা। দলের নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে গ্রেনেড হামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন তা দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে। গ্রেনেড হামলায় দলের সিনিয়র নেত্রী সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভী রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান এবং আহত হন শতাধিক।