South east bank ad

প্রশাসনে কাটেনি অস্থিরতা

 প্রকাশ: ১৮ অগাস্ট ২০২৪, ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন   |   মন্ত্রণালয়

প্রশাসনে কাটেনি অস্থিরতা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে তৈরি হওয়া অস্থিরতা ও আতঙ্ক এখনও কাটেনি। বিদায়ি সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত ভিন্নমতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকার পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে পদোন্নতি ও পদায়নের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে দলবাজ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের কক্ষে প্রবেশ করে হেনস্থা করার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে ভেঙে পড়েছে ‘চেইন অব কমান্ড’।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিব পদমর্যাদার ১০ জন কর্মকর্তার চুক্তি বাতিলসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর বিগত সরকারের আস্থাভাজন ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই চাকরিচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এতদিন কোণঠাসা কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিতে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন। ‘বিএনপিপন্থি’ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যাওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগও করছেন বলে জানা গেছে। আর সুযোগ বুঝে অনেকে এখন ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করে বলছেন সরকারের চাপের কারণে এতদিন তারা সরকারের পক্ষে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় বিবেচনায় অগ্রাধিকার বেশি দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে সরকার পরিবর্তনের পরই এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি, পদায়ন ও নতুন নিয়োগের কাজ শুরু করেছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মোট ১৯ জন পূর্ণ সচিবের মধ্যে গত বুধবার ১০ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করা হয়েছে। নতুন উপদেষ্টা পরিষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর একে একে সরে যেতে শুরু করেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তারা। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন অনেক বিভাগ, সংস্থা ও অধিদফতরের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। বিভিন্ন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগ, রদবদল ও পরিবর্তনের মিছিল গত কয়েক দিন ধরে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে।

সরকার পতনের পর সচিবালয়ে দীর্ঘদিনের পদোন্নতি বঞ্চিতদের ভিড়ে মিছিল-সমাবেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন কোণঠাসা কর্মকর্তারা ভালো পদায়নের প্রত্যাশায় ধরনাও দিতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে জনপ্রশাসন বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগে গত কয়েক দিন ধরে কর্মকর্তাদের ভিড় করতে দেখা গেছে। পদোন্নতির আবেদন জমা দিচ্ছেন তারা।

পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার ১১ থেকে ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগ পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদায় আটকে থাকা ১১৭ জনকে উপসচিব হিসেবে ভূতাপেক্ষকভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা ভূতাপেক্ষকভাবে বিধি মোতাবেক আর্থিক সুবিধা প্রাপ্য হবেন। এরপর ২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসে নিয়োগ বঞ্চিত ২৫৯ জনকে নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, কীভাবে বদলি হচ্ছে, পদোন্নতি হচ্ছে, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবল যে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিতদের পদোন্নতি হচ্ছে তা নয়; অযোগ্য, অদক্ষতার কারণে পিছিয়ে পড়া লোকজনও এই সুযোগে পদোন্নতি নিয়ে নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অসন্তোষ দমনে বিসিএস বিভিন্ন ব্যাচের উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া হবে। এ রকম ১৫০ উপসচিব ও ১০০ যুগ্ম সচিবের পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে।

পদোন্নতি বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ফোরামের সভাপতি বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, তারা দীর্ঘ ১৬ বছর বঞ্চনার শিকার। এই বঞ্চনা দূর করতে যারা যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য, তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিতে হবে। তাই তাদের আর ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী সরকারের আমলে প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন কয়েকশ কর্মকর্তা। গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় বঞ্চিত করা হয়। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন দিতে শুরু করেছেন বৈষম্যের শিকার পদোন্নতি বঞ্চিত বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, সরকার পতনের পর থেকে তাদের কেউ কেউ জুনিয়র সহকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানাকে জুনিয়র কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত করার পর তিনি পুলিশ পাহারায় অফিস ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সরকার বদলের সুযোগে শুধু কর্মকর্তারা নন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন। নতুন সরকারের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতে নিয়মিত মিছিল-জমায়েত করছেন সচিবালয়ে। সচিবালয় ছাড়িয়ে আন্দোলনের এ ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দফতর ও সংস্থাগুলোতেও। এসব প্রতিষ্ঠানে বদলি ও পদোন্নতি নিতে দৌড়ঝাঁপ করছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। আর এসব সংস্থায় আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে যারা এতদিন দাপট দেখিয়েছেন অনেকে এখন অসুস্থতার কথা বলে অফিস করছেন না। কাউকে কাউকে ঢাকার বাইরেও বদলি করা হয়েছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি দলীয়করণের কারণেই প্রশাসন ও সরকারে একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তখন যদি যোগ্য ও মেধাবীরা এসব পদে থাকত তা হলে হয়তো তাদের সরে যেতে হতো না। তাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগদানের কারণে সরকার পরিবর্তনের পর সে সব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার করতে হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে। তবে প্রশাসনে সংস্কারের ক্ষেত্রে আবারও ‘আরেকটি দলীয়করণ’ যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, এতদিন যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছিলেন। পটপরিবর্তনের কারণে ওইসব পদে থাকা ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় সরে যাচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পদ থেকে। তিনি বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগগুলো দেখে দেখে বাছাই করা হয়, যারা সরকারের সবচেয়ে বেশি পারপাস সার্ভ করেছে তারাই এমন নিয়োগ পেয়েছেন বিগত সরকারের সময়। স্বাভাবিক নিয়মে প্রশাসনের কোনো পদ খালি হওয়ার পর আরেকজন কর্মকর্তা বসেন সেই পদে। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেকেই মনে করেন তারা পদবঞ্চিত হয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, যখন সরকার পরিবর্তন হয়, তখন আরেকটু জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন দরকার হয়। দায়িত্বে থেকে এখন যারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না, সে সব জাতীয় জায়গায় দ্রুত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশেষ বিবেচনায় অনেক জায়গায় চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগ পেয়েছিল অনেকে। আমরা সেগুলোকে বাছাই করে যাদের প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে না তাদের বাদ দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দিচ্ছি।
BBS cable ad