পাল্টে গেছে সচিবালয়ের দৃশ্যপট

প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়। গতকাল বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এক অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। সেই অন্য ধরনটা হচ্ছে, নতুনদের পদচারণ। গত ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টাসহ ১২ জন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। এর এক দিন পর অর্থাৎ শনিবার ছুটি উপেক্ষা করে দুজন উপদেষ্টা সচিবালয়ে তাদের দফতরে আসেন। আর গতকাল সকাল থেকেই একের পর এক সব উপদেষ্টা তাদের অফিসে আসেন। তবে গতকাল দুজন শপথ নিলেও তারা তাদের দফতরে আসেননি।
প্রত্যেক উপদেষ্টা তাদের দফতরে এসেই ফুলেল শুভেচ্ছা পান। আর যার যার মন্ত্রণালয়ের সচিবরা তাদের শুভেচ্ছা জানান। সকাল ৯টা থেকে সচিবালয়ে একের পর একজন দফতরে আসেন। সচিবালয়ের প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা না থাকলেও অন্যান্য সংস্থার বাহিনীর সদস্যরা তাদের গাড়ি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে স্যালুট জানান। বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় আগে থেকে প্রস্তুত ছিল তাদের দফতরের উপদেষ্টাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য।
সচিবালয়ে প্রথমেই প্রবেশ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান। দফতরে এসেই তিনি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব। একই সঙ্গে সবার সঙ্গে পরিচিত হন।
এ সময় সৈয়দা রিজওয়ান হাসান বলেন, শুধু আমার অবস্থান বদলেছে। কিন্তু দায়িত্ব বদলায়নি। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে যতগুলো দফতর রয়েছে তারা যেন পরিবেশের মতো ন্যায়বিচারটা দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। সেভাবে তাদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। ডেলিভারি ভালো করতে হবে। জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা বেছে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যে প্রত্যাশা যোগ হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে আমাদের একটা সংযোগ তৈরি করতে হবে। জনগণের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পরে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
সচিবালয়ের ৬নং ভবনে অনেক মন্ত্রণালয় রয়েছে। এ ভবনের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে আসেন নবনিযুক্ত উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার। তিনিও গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, মাত্র কাজে যোগ দিয়েছি। আমি খোঁজখবর নেব। তারপর কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিতে হবে সেগুলো ঠিক করে কাজ এগিয়ে নেব। এই উপদেষ্টা বলেন, প্রথম কাজ হচ্ছে মানসম্মত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। আমিষ নিশ্চিত করা।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন তার দফতরে শনিবারই যান। সে সময় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেছেন। গতকালও কথা বলেছেন। তবে গতকাল তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবসহ বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সম্মেলন কক্ষে বৈঠক করেন। তিনি সচিবালয়ে বসেই জানতে পারেন ইসলামী ব্যাংকের গুলির ঘটনা। তিনি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জানান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সচিবালয়ে আর্কষণ ছিল দুজন তরুণ উপদেষ্টার দফতর। দফতরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফুলেল শুভেচ্ছা পান। পাশাপাশি তাদের অধীনে সংস্থাগুলোর প্রধানরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় খুব কাছাকাছি হওয়ায় একঝাঁক তরুণের পদচারণ দেখা গেছে। ফুলের সঙ্গে কারও কারও হাতে মিষ্টি ও কেকের বাক্স দেখা গেছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা এবং যুব ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ অত্যন্ত বিনয় নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের আপসহীন মনোভাব সবাইকে উজ্জীবিত করবে বলে প্রত্যাশা করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
রোববার প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এখানে মিডিয়াকে একটি কড়া বার্তা দেন। আর তা হলো-এ দেশে রাজনীতি করতে হলে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্টের মধ্যে করতে হবে। এটি আপনাদের পছন্দ না হলেও করতে হবে। আমি যতদিন আছি এটি করে ছাড়ব। তিনি চাঁদাবাজদের ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দখল, চাঁদাবাজি করলে সেনাবাহিনীকে বলেছি পা ভেঙে দিতে। আমি বারবার বলছি, চাঁদাবাজি করবেন না। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, আপনারা আপনাদের লোক সামলান। নইলে দেখেছেন তো ওপর থেকে পড়তে বেশি সময় লাগে না।
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ সময়মতো সচিবালয়ে তার দফতরে আসেন। তিনি এসেই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। পরে তিনি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বলেন, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ। পাশাপাশি তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও করপোরেশনের কাউন্সিলররা যেন দ্রুত তাদের কাজে যোগ দেন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কারণ জনসাধারণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ুক তা আমরা চাই না।
সর্বোপরি সচিবালয়ে উপস্থিত উপদেষ্টারা সবাই কম-বেশি অফিস করেছেন। তবে বেশিরভাগ সময় কেটেছে শুভেচ্ছা বিনিময়ে। সচিবালয়ে কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কোনো ধরনের দাফতরিক কাজ হয়নি। বরং বেশিরভাগ সচিব রয়েছেন আতঙ্কে। বিশেষ করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সচিবরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন সচিব এ প্রতিনিধিকে জানান, কীভাবে কাজ করব। মাথার ওপর কে যেন খর্গ ধরে রেখেছে, এ ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে। তবে এদের মধ্যে একজন বলেছেন, সরকার যদি চলে যেতে বলে চলে যাব। আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যদি বাতিল করে তাতেও রাজি। আমরা মানসম্মান নিয়ে যেতে চাই। কোনো ধরনের অসম্মান হতে চাই না।
আরেক সচিব জানান, এটি তো সত্যি অনেকেই পদবঞ্চিত হয়েছেন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা পদোন্নতি পাননি। এটি তাদের মনের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ জমা হয়েছে। এতদিনের ক্ষোভ একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।
এদিকে সচিবালয়ের দৃশ্যপটে এ দৃশ্য অস্বাভাবিক, তা হলো-কোনো দর্শনার্থী ছিল না। প্রবেশমুখে ছিল না কোনো পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। সাদা পোশাকে কর্তব্যরত বিশেষ সংস্থার প্রতিনিধিরা প্রবেশমুখে পরিচয়পত্র একবার চোখ বুলিয়ে নেন। যে ধরনের কড়াকড়ি থাকার দরকার তা ছিল না বললেই চলে। তবে সচিবালয়ের সামনে সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখা গেছে।
রোববার বেলা ১১টার পর থেকে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে। তারা বেশ কিছুক্ষণ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় সামনের পুরো গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতা বলেন, শেখ হাসিনার সময়ে যারা সচিব ছিল তাদের দ্রুত অপসারণ চাই। তারা শেখ হাসিনার দালাল। আমরা চাই আইনের আওতায় এনে তাদের ফাঁসি দেওয়া হোক।
একই সঙ্গে ৬ দফা দাবিতে বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের একদল কর্মচারী। পরে তারা সচিবালয় বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম কার্যালয়ে আসেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন তাদের ৬ দফা দাবির কথা সাংবাদিকদের জানান।
উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল-১০ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে উন্নীত করে উপ-সহকারী সচিব হিসেবে পদের নাম দেওয়া, ১১ থেকে ১৬ গ্রেডের পদের নাম অতিরিক্ত উপ-সহকারী সচিব, ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের পদের নাম সাচিবিক সহায়ক। এ ছাড়াও সচিবালয় ভাতা চালু করার দাবি করা হয়।
সচিবালয়ের অভ্যন্তরে যে কয়েকটি ক্যান্টিন রয়েছে তা বেশিরভাগ চালু হলেও বেচাকেনা হয়েছে খুব কম। সচিবালয়ে অভ্যন্তরে গাড়ির বহর দেখা গেলেও বেশিরভাগ গাড়ি ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের। গতকাল সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার অধীন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে তা বাতিল করা হয়।