রিতার সাংগঠনিক দক্ষতায় মানিকগঞ্জে বিএনপি আবারো উজ্জীবিত

মানিকগঞ্জের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয় একটি স্লোগান ছিল— "মানিকগঞ্জের মাটি, ধানের শীষের ঘাঁটি"। বিভিন্ন সময় রাজনীতির জোয়ার-ভাটায় সেই স্লোগানের আবেদন হয়তো কিঞ্চিৎ ম্লান হয়েছিল, কিন্তু ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তা ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। এই পুনর্জাগরণের কেন্দ্রে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা।
দলীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, তার দূরদর্শী নেতৃত্ব, সাহসিকতা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় বিএনপি আবারো উজ্জীবিত মানিকগঞ্জে। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম হারুণার রশিদ খান মুন্নুর নির্বাচনি সমন্বয়কারী হিসেবে রাজনীতির প্রথম সারিতে আত্মপ্রকাশ করেন আফরোজা খানম রিতা। এরপর বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের প্রতিনিধি সম্মেলন, তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক কর্মসূচি এবং জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করেন একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে মানিকগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্রিয় থাকার পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক ভিত্তি দৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
শত দমন-পীড়নের মধ্যেও তিনি অটল ছিলেন নেতাকর্মীদের পাশে। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে ধরপাকড় ও মামলা শুরু হয়, মানিকগঞ্জ জেলা ছিল তার অন্যতম টার্গেট।
দলীয় সূত্র অনুযায়ী, জেলার প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১৭২টি রাজনৈতিক মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় ব্যক্তিগত খরচে আইনি সহায়তা দেন আফরোজা খানম রিতা, যা তাকে কর্মীদের কাছে এক ভরসার জায়গায় পরিণত করে।
তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকা সত্ত্বেও তিনি মাঠের রাজনীতি থেকে পিছু হটেননি। বরং প্রতিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানিকগঞ্জ জেলায় অন্যতম সক্রিয় নেত্রী ছিলেন রিতা। ৪ আগস্ট মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের মহাসমাবেশে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং পরে সরকার পতনের পর প্রশাসনিক শূন্যতা মোকাবিলায় নিজ উদ্যোগে দলের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
তখন মানিকগঞ্জ জেলার ১৬৪২টি গ্রাম, ৬৫টি ইউনিয়ন, ৭টি থানা ও ২টি পৌরসভায় পাহারা ও সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হয় তার নির্দেশনায়। এছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূজামণ্ডপ ও বসতবাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও দলীয় কর্মীদের সংগঠিত করেন তিনি।
সাংগঠনিক শক্তি এবং নির্বাচনি প্রস্তুতি
২০১৫ সালে জেলা ও উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০২১ সালের জেলা বিএনপির কাউন্সিলে ৪৫ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৪২ জনের ভোট পেয়ে জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
২০২৩ ও ২০২৪ সালে ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কর্মসূচি, র্যালি ও সমাবেশে হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন রিতা। নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার রোডমার্চে নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেন।
জেলায় দলের ভেতরের বিভাজন মিটিয়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব ও পরিচিতির কারণে ২০২৪ সালের ১৫ জুন তাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী মনোনীত করা হয়। এর আগে তিনি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি তার নিজ বাসভবন মুন্নু সিটিতে বিভিন্ন সময় দলের বিভাগীয় সভা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে জেলা পর্যায়ের ১৩০০ নেতাকর্মীর অংশগ্রহণে প্রশিক্ষণ কর্মশালারও আয়োজন করেন তিনি।
শিক্ষা ও পারিবারিক জীবনেও রিতা একজন কৃতী ব্যক্তিত্ব। অগ্রণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি উইমেন্স ফেডারেশন কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান।
তার তিন পুত্রসন্তান লন্ডনের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। তার স্বামী মইনুল ইসলাম ছিলেন মুন্নু গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান।
দলীয় নেতাকর্মীদের চোখে একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক তিনি। বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, ছাত্রদল ও আইনজীবী ফোরামের স্থানীয় নেতারা তার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তাদের মতে, রিতা কেবল একজন নেতা নন, একজন অভিভাবকের মতো সংগঠনের প্রতিটি স্তরে কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন তিনি।
জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল খালেক শুভ বলেন, “তিনি ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এলেও রাজনীতির মাঠে সার্বক্ষণিক ছিলেন বলেই আমরা সাহস পাই।”
জেলা বিএপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন খান বলেন, “রিতা আপার নেতৃত্বে মানিকগঞ্জে বিএনপি আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ।”
আফরোজা খানম রিতা দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমা, নেতৃত্ব গুণ ও সাংগঠনিক তৎপরতায় মানিকগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছেন। মাঠের রাজনীতি থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব, কর্মীদের প্রতি দায়িত্বশীলতা তাকে দলের জেলা কান্ডারিতে পরিণত করেছে।