South east bank ad

সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে কমে আসছে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব

 প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন   |   পুলিশ

সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে কমে আসছে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ও বিরোধী মত নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার অনেকটাই পুলিশনির্ভর হয়ে পড়েছিল। ফলে অতি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার মানসিকতা তৈরি হয় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে। বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে তখন, যার বড় উদাহরণ তৈরি করেছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড। একধরনের শীতল সম্পর্ক তৈরি হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে। সে সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ অনেকটাই ঘি ঢেলেছিলেন দুই বাহিনীর মধ্যে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে। দেখা দেয় আস্থার সংকট।

জুলাই অভুত্থ্যানের পর বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয় পুলিশ। একপ্রকার নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন বাহিনীটির সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনবল চাঙা করতে পাশে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী। পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার থেকে শুরু করে, থানা স্থাপনার নিরাপত্তা, টহল ও তল্লাশি কার্যক্রমেও পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন সেনা সদস্যরা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে চালানো হচ্ছে যৌথ অভিযানও। আর এর মধ্য দিয়ে সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী দুটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ঘুচে গড়ে উঠছে একটি শক্তিশালী সহযোগিতা ব্যবস্থা, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়েছিলেন। গুম-খুন ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। এসব অপরাধে জড়িয়ে পুলিশ আস্থার সংকটে পড়ে। নৈতিকভাবে দুর্বল হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর আনুগত্য বিবেচনায় কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে বিশেষ ক্ষমতা ও সুবিধা দেয় দলটি। তাদের হাত ধরেই নানা অনিয়ম-কারচুপির মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। ওই বছরের শেষ দিকে পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পান একেএম শহীদুল হক। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত।

তারা আরো জানান, আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর পুলিশের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা তুলে ধরেন নানা আবদার। পুলিশের জন্য ভারী অস্ত্র কেনার দাবিও জানানো হয়। সেনাবাহিনীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের সে দাবি মেনে নিয়ে পুলিশ সদস্যদের হাতে সরকার তুলে দেয় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের ভারী অস্ত্র ও বিস্ফোরক।

এ বিষয়ে ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (এফএসডিএস) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বিগত সময়ে দেখেছি পুলিশের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। সেনাবাহিনী যে ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে তাদেরও সেই অস্ত্র দিতে হবে। সেনাবাহিনী তো এ অস্ত্র বাইরের শত্রুকে ঘায়েলে ব্যবহার করে। আর পুলিশ এ প্রাণঘাতী অস্ত্র দেশের জনগণের ওপর ব্যবহার শুরু করল। এটা ছিল একটা বড় ধরনের ভুল।’

থানাকে বাংকার বানিয়ে পুলিশকে এলএমজি ব্যবহার করতেও দেখা গেছে বলে মন্তব্য করেন অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে থানাগুলো হয়ে উঠেছিল দুর্গের মতো। এসব অস্ত্র কাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবহার করবে? পুলিশ যখনই ওই মাত্রায় যাবে, বুঝতে হবে তারা একদমই অকার্যকর হয়ে গেছে। সুতরাং সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতিযোগিতার বিষয়টি তাদের একদমই ভ্রান্ত ধারণা।’

এফএসডিএসের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আরো বলেন, ‘আগামী দিনের সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য অবশ্যই পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পেতে পারি।’

সাবেক এক আইজিপির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারী অস্ত্র ও বিস্ফোরকই নয় কেবল, ২০১৬ সালে পুলিশের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা নিজেদের সুপার পাওয়ার ভাবতে শুরু করেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সেনা কর্মকর্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও ভাবতেন। তারই ধারাবাহিকতায় পুলিশপ্রধানকে চার তারকা (ফোর স্টার) জেনারেল অর্থাৎ সেনাপ্রধানের সমমর্যাদা দেয়ার দাবি জানানো হয়। এ দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারও আলোচনা অব্যাহত রাখে। পুলিশের প্রস্তাব বিবেচনা করা হলে অতিরিক্ত আইজিপি হতেন সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল, ডিআইজি হতেন মেজর জেনারেল আর অ্যাডিশনাল ডিআইজি হতেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের সমতুল্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে অবশ্য মর্যাদা-সংক্রান্ত এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নানা মতামত তুলে ধরা হয়। কারো কারো অভিমত ছিল, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে আন্তঃবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিতে পারে। পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়, সম্মান দেয়া হলে তারা কাজের ক্ষেত্রে উৎসাহ পাবেন। এতে সমন্বয়হীনতা ঘটার কোনো কারণ নেই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার অনুমোদন মেলেনি।

মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার পুলিশকে একটা সুপার পাওয়ারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। বাহিনীটিকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করিয়েছে। একপর্যায়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি সেনাবাহিনীর সঙ্গেও পুলিশের একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা দেখলাম পুলিশ যখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ল, তখন সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের এবং বিভিন্ন থানা স্থাপনার নিরাপত্তা দিল। এমনকি পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারেও ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমে এসেছে বলে আমি মনে করি। সামরিক ও বেসামরিক দুটি বাহিনীই এখন একসঙ্গে মিলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছে। তবে মনে রাখতে হবে, দেশ এখনো চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখানে আরো দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে।’

পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্বের বিষয়টি সবার সামনে একদম পরিষ্কার হয়ে ওঠে ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে, কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর। চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আলোচিত এ ঘটনার জন্য বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে দুঃখ প্রকাশ করার পরও পুলিশের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উল্টো নিহত মেজর সিনহার অন্যতম সহযোগী শিপ্রা দেবনাথের ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে হেনস্তার চেষ্টা করেন। এমনকি ভিকটিমদের ওপর দায় চাপিয়ে মামলাও করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। যদিও মেজর সিনহার বোনের দায়ের করা মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারসহ নয় পুলিশ সদস্যকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনো সরকারেরই একটা দেশ চালানোর জন্য বিভিন্ন ডেস্ক থাকে। এখানে পুলিশ যেমন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে, তেমনি সেনাবাহিনী থাকে বহিঃশত্রু মোকাবেলায়, প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায়ও মাঠে নামে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ওয়ান বুলেট, ওয়ান এনিমি। অর্থাৎ সেনা সদস্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যে একটি গুলিতে একজন শত্রু আহত বা নিহত হতে হবে। আর পুলিশের ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে সর্বনিম্ন বলপ্রয়োগ। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা তাদের মূল দায়িত্ব। কিন্তু কখনই গুলি করে কাউকে মারার দায়িত্ব পুলিশের না।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত সময়ে আমরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যে একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব লক্ষ করেছি, সম্প্রতি সেটা দূর হয়েছে। পুলিশের কিছু উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তার জন্য মূলত এমন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন দুই বাহিনী একসঙ্গে নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করছে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমি মনে করি এ সময়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যথায় দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। এই যেমন সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়া ও লালমনিরহাটের দুটি ঘটনা নতুন করে পুলিশের মনোবলে চিড় তৈরি করছে। এ ধরনের মব কালচারও আমাদের প্রতিহত করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলোর বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা।’

BBS cable ad