South east bank ad

গুরুত্বপূর্ণ ৬ পদে নেই কনসালট্যান্ট

 প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২২, ০১:২৩ অপরাহ্ন   |   সারাদেশ

গুরুত্বপূর্ণ ৬ পদে নেই কনসালট্যান্ট
বিডিএফএন লাইভ.কম

এক যুগেরও অধিক সময় আগে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল উন্নীত হয় ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও উন্নতি হয়নি চিকিৎসা সেবার মানের। স্বল্প আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও বিশেষজ্ঞ না থাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে হাসপাতালটি। দালালদের সঙ্গে আঁতাত করে কমিশনের মাধ্যমে কাজ করছে হাসপাতালেরই একটি চক্র। সম্প্রতি চিকিৎসক সংকট কিছুটা নিরসন হলেও গুরুত্বপূর্ণ ৬ পদে নেই কনসালট্যান্ট। ফলে প্রকৃত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ত্রিশালবাসী। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিরও রয়েছে সংকট। স্পেশালিস্ট জনবল না থাকায় প্রায় দুই বছর যাবৎ বন্ধ আল্ট্রামনোগ্রাম মেশিন।

এ হাসপাতালে চিকিৎসকের ৩৪ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২২ জন। ডিজি অফিস থেকে প্রেষণে গত মাসে দেওয়া হয়েছে সহকারী সার্জন ১৩ জন। এ ছাড়া ৬ জন মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন। উপজেলার ১২ ইউনিয়নে ১২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও মাত্র ৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক আছেন। সেগুলো হচ্ছে- উপজেলার ধানীখোলা, কানিহারী, মোক্ষপুর ও বালিপাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বাকি ৮ জন চিকিৎসক সেবা দেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ সার্জারি, চক্ষু, ডেন্টাল, শিশু, চর্ম ও যৌন এবং প্যাথলজিস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এসব পদে চিকিৎসক না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স রয়েছেন ৩৯ জন। এ ছাড়া ৫৯ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদের বিপরীতে কর্মরত মাত্র ২৯ জন। ফলে দাপ্তরিক কাজ ছাড়াও ব্যাহত হচ্ছে অনেক কার্যক্রম। চতুর্থ শ্রেণির ২৬ কর্মচারীর মধ্যে কর্মরত রয়েছে ২২ জন। এক বছরের অধিক সময় ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন ২ জন। তবে তাদের বেতনভাতা বন্ধ রয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

শূন্য থাকা পদের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ডেপুটেশন, প্রমোশন ও বদলিজনিত কারণে বেশ কিছু পদ শূন্য রয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়োগ প্রক্রিয়া না থাকায় এ পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চিকিৎসাসেবায় অনিয়ম : ৫০ শয্যার এ হাসপাতালে স্থায়ীভাবে চালু নেই অপারেশন থিয়েটার, দীর্ঘদিন পূর্বে হাতেগোনা কয়েকটি সিজারের মাধ্যমে ওটি উদ্বোধন করলেও টেকেনি বেশি দিন, বন্ধ হয়ে যায় ওটি এবং রূপ নেয় গোডাউনে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে আবারও চালু করা হয়েছে সিজারিয়ান অপারেশন, তবে যে কোনো সময় এ অপারেশন নয়, কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও সহযোগীদের সুবিধা অনুযায়ী সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে। ননস্টপ অপারেশনের সুবিধা নির্ধারিত সময় না থাকায় সিজারিয়ানের রোগীরও সারা মেলে না তেমন। হাসপাতালের সুবিধাজনক সময়ে কোনো সিজারিয়ান রোগী না এলে রেফার্ড করা হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম সিজারিয়ান রোগী পাঠাতে বলেন তাদের সুবিধাজনক সময়ে।

বিদ্যুতের বিকল্প তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বিকল্প হিসেবে অফিসের জন্য রয়েছে একটি আইপিএস ও ৫০ শয্যার তিনটি ওয়ার্ড ও পুরো হাসপাতালের জন্য দায়সারাভাবে রয়েছে আরেকটি আইপিএস। এ ছাড়াও সিজারিয়ান অপারেশন থিয়েটারের জন্য রয়েছে ছোট্ট একটি জেনারেটর যদিও তা বিকল হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের দোতলায় জেনারেটর রুমে একটি বড় জেনারেটর ছিল পুরো হাসপাতালের জন্য তবে সরেজমিনে জেনারেটরের বক্সটি খালি পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল করিডরের জন্য দীর্ঘদিন পূর্বে দুইশ কেবি ট্রান্সফরমারের চাহিদা দেওয়া থাকলেও রয়েছে ১০০ কেবি ট্রান্সফরমার। ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় বিদ্যুৎ থাকলেও সিঁড়িসহ হাসপাতালের অলিগলি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের খাবারের মাঝেও থেমে নেই অনিয়ম। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সাপ্তাহিক খাবার মেন্যুও মানছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

গত মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সবশেষ খাবার মেন্যুতে দুপুরের খাবার ছিল মাংস (মুরগি ব্রয়লার), সবজি ও ডাল। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার দুপুরে মেন্যু অনুযায়ী রান্না হয়নি বাবুর্চিখানায়। মেন্যুতে দেওয়া খাবারের পরিবর্তে রান্না করা হয়েছে ছোট রুই মাছ ও ডাল। তবে কুক সোহরাব হোসেন জানালেন, বৃহস্পতিবার ও রবিবার ব্রয়লার মুরগির মাংস দিয়ে থাকেন। টিএইচও স্বাক্ষরিত খাবারের মেন্যু নিজ দায়িত্বে কীভাবে পরিবর্তন করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এ ছাড়াও ৫০ শয্যার ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি রয়েছে অরক্ষিত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘেঁষে অবস্থিত এ হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরটি একবারেই অরক্ষিত। প্রায় দুযুগ পূর্বে ওই সীমানা প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভেঙে পড়া অংশের সীমানা প্রাচীরটুকু মেরামত না করার ফলে কমপ্লেক্সটির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও রাতের বেলায় রোগী, স্বজন, হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট লোকজন ছাড়া বহিরাগতদের আনাগোনা নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন ফয়জুর রহমানসহ স্থানীয়রা।

গত শনিবার উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের বীররামপুর গফাকুড়ি এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন মাওলানা দেলোয়ার হোসেন। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে। তিনি দুদিন যাবৎ শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তরের পর কয়েকটি ওষুধ লেখেন চিকিৎসক, হাসপাতালে তা না থাকায় বাইরের ফার্মেসি থেকে ক্রয় করে আনতে হচ্ছে। এর পর গত দুদিনে আসেনি কোনো চিকিৎসক।

মকবুল হোসেন নামে সাখুয়া ইউনিয়নের আখরাইল গ্রামের আরেক রোগী বুক ও শরীর ব্যথা নিয়ে রবিবার ভর্তি হন হাসপাতালে। তিনি জানান, রবিবার ভর্তি হলেও সোমবার দুপুর পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। জরুরি বিভাগ থেকে দেওয়া ৫টি ট্যাবলেটেই চলছে চিকিৎসা।

স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফাহাদ জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে ত্রিশাল হাসপাতালে। ডাক্তারের রুম থেকে রোগীরা বের হতেই ওঁৎ পেতে থাকা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রেসক্রিপশন দেখতে ঘিরে ধরেন রোগীকে। পুরুষ বা মহিলা যেই হোক তাদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি উঠিয়ে থাকে। কেউ দিতে না চাইলে তাদের অনেকটাই জোরজবরদস্তি করা হয়ে থাকে। রোগীর প্রেসক্রিপশনে তার ব্যক্তিগত অনেক তথ্য থাকে, যা অনেক কিছু গোপনীয় কিন্তু কোম্পানির লোকজনকে ওই সব প্রেসক্রিপশন দেখে হাসাহাসিও করতে দেখা যায়। তাই ত্রিশাল হাসপাতালকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল ও ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ত্রিশালের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল বলেন, হাসপাতালে আগত রোগীরা সঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এ ছাড়াও আরও অনেক সমস্যা রয়েছে তবে তা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল ও কোম্পানির লোকজনের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে, তারপরেও যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সার্জারি, চক্ষু, ডেন্টাল, শিশু, চর্ম ও যৌন ও প্যাথলজিস্ট চিকিৎসক না থাকা বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েকজন বদলি হওয়া ও ডেপুটেশনে থাকায় পদগুলো শূন্য রয়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট চিকিৎসক চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ত্রিশালবাসীর জন্য ভালো আরও একটি খবর হচ্ছে, অতি দ্রুত সময়ের মাঝে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যা থেকে উন্নীত হয়ে ১০০ শয্যা হওয়ার কথা রয়েছে। 
BBS cable ad