সাফল্যে গাঁথা নারী কৃষক নুরুন্নাহার বেগমের পেছনের গল্প

সুশান্ত কুমার সরকার, (পাবনা) :
সজবি চাষ করা খুব একটা কঠিক কাজ নয়। বাড়ীর আঙ্গিনাতেই নারীরা অতি সহজেই সবজি চাষ করাতে পারেন। এর পর ধীরে ধীরে ব্যাপক পরিসরে চাষ করা যেতে পারে বিভিন্ন সজবি। এমন পরিকল্পনা থেকে বাড়ীর আঙ্গিনায় শশা ও বেগুন চাষ শুরু করেন। এরপর নানান সবজির পাশাপাশি ধান, গমসহ বিভিন্ন কৃষিপন্য চাষ ও গবাদিপশু পালন করে সারা জাগিয়েছেন এলাকাজুড়ে। প্রশংসা কুড়িয়েছেন বিভিন্ন মহল থেকে। অর্জন করেছেন একাধিক রাষ্ট্রয় সম্মাননা পুরষ্কার। বলছিলার পাবনার ঈশ^রদী উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগমের কথা। কৃষি ও পল্লীউন্নয়নে গৌরবময় অবদানের জন্য গত ৮ আগস্ট তিনি পেয়েছেন “বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক ২০২১”।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পিপুলি পাড়া গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৯৭৭ সালের ২৪ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগম। পিতা আব্দুল গফুর মোল্লা ও মাতা আনোয়ারা বেগম। সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়ে হওয়ায় ১৯৯১ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জেলার ঈশ^রদী উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম বিশ^াসের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের ৬ মাসের মাথায় শ^শুর বাড়ি থেকে তাদের সংসার ভিন্ন করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই শুরু হয় সংসারের আয় বৃদ্ধি এবং সফলতা অর্জনের সংগ্রাম। কিভাবে পরিবারের স্বচ্ছলতা আনা যায় সেই চিন্তা থেকেই টিনশেড ছোট্ট বাড়ির আঙ্গিনায় শশা ও বেগুন চাষ শুরু করেন নুরুন্নাহার বেগম। একদিন খবরে দেখতে পান বগুড়া জেলার কোন এক নারী সবজি চাষ করে অনেক টাকা আয় করেছেন। সেই থেকে তার মনবল আরো বেড়ে যায়।
নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ২০০২ সালে ব্র্যাক এনজিও থেকে মাত্র ২ হাজার টাকা ঋণ নেন। ঐ টাকা দিয়ে বাড়ির পাশে ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ শুরু করেন। এর পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও ছাগল-ভেড়া পালন শুরু করেন। ধীরে ধীরে সফলতার মুখ দেখতে পান এবং পরিধি বাড়াতে থাকেন। পরের বছর তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২টি গাভী ক্রয় করেন এবং ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সবজির আবাদ বাড়িয়ে দেন। এরপর থেকে তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করেন। তিনি জানান, শশা, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, মুলাসহ অন্যান্য সবজির পাশাপাশি ধান, গম, বিভিন্ন জাতের পেয়াজ, পেয়াজ বিজ প্রস্তুত, আলু চাষ করে ব্যাপক সারা জাগিয়েছেন। কৃষি পন্য উৎপাদনে তিনি ব্যর্থ হননি। ফলের মধ্যে কলা, কুল, থাই পেয়ারা, ড্রাগন এবং লিচু বাগান রয়েছে। সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে রয়েছে পুকুর। সেখানে দেশিয় জাতের মাছ চাষ করা হয়। তিনি আরো বলেন, প্রায় ৪০/৪৫ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করে থাকেন। সাড়ে ৭ বিঘা জমিতে কলা বাগান, ২৫ বিঘা পেয়ারা বাগান এবং ১৩ বিঘা জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। বর্তমানে তিনি গরুর খামার তৈরিতে বেশি জোড় দিয়েছেন। তার নিজের মালিকানাধীন ১১ বিঘা জমিতে নতুন করে বড় পরিসরে গরুর খামার তৈরির কাজ শুরু করেছেন। তার পরিকল্পনা রয়েছে খামারে উৎপাদিত দুধ থেকে ঘি, মাখন, ছানা ও দই তৈরি করে সরবরাহ করবেন। তার নিজের নামে ২৯ বিঘা জমি রয়েছে এবং বর্তমানে লিজ নেওয়া জমি রয়েছে ৬০ বিঘা।
বিভিন্ন সময় ব্যাংক এশিয়া, অগ্রণী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তিনি ঋণ নিয়ে তার কৃষি কাজের প্রসার ঘটিয়েছেন। আবার সময় মতো সব ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছে। এ জন্য তিনি ব্যাংক থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি বলেন, যে কোন ভালো কাজ করতে গেলে নানা ধরনের বাধা আসতে পারে নানান জন নানা কথা বলতেই পারে। আমি যখন কৃষির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে যেতাম তখন বিভিন্ন মানুষর নানা কথা বলতো। কিন্তু আমি সেগুলোতে কান দিতাম না। তাই আজ আমি সফলতা অর্জন করতে পেরেছি। আমার কাজে আমার স্বামী আমাকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন।
মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগম দুস্থ ও অসহায় নারীদের সেবা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন জয় বাংলা নারী উন্নয়ন সবায় সমিতি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নারীদের একত্রিত করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। তিনি নিজে জামিনদার হয়ে প্রায় ১ হাজার ৩শ’ নারীকে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। প্রাপ্ত ঋণের টাকা দিয়ে প্রত্যেকেই নিজের বাড়িতে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন। বর্তমানে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে পশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তায় বাসভবনের পাশে নিজের জমিতে একটি ট্রেনিং সেন্টার ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যার ভবন নির্মাণ কাজ চলছে।
কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের মোছাঃ নুরুন্নাহার বেগমের সফলতা অর্জনের ফলে “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার”, “কেআইবি কৃষি পদক ২০১৭” “বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক ২০২১” সহ ৪টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এসব পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে তিনি গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি কৃষিতে সাফল্য অর্জনের জন্য স্থানীয়ভাবে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সংসার জীবনে স্বামী রবিউল ইসলাম বিশ^াস এবং ৪ ছেলে সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবার করছেন।