সশস্ত্র বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতেই হবে

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। আমাদের সার্বভৌমত্বের রক্ষক।
সশস্ত্র বাহিনী আমাদের অহংকার ও গৌরবের প্রতিষ্ঠান। আর তাই এ বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে যদি বিতর্কিত করা হয়, যদি হেয় প্রতিপন্ন করা হয় তাহলে আমাদের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বিপন্ন হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। সবার আগে দেশ এটি আমাদের মনে রাখতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক, আমাদের অস্তিত্বের স্মারক সশস্ত্র বাহিনীকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা হচ্ছে। সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি নানা রকমভাবে সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করছে, গুজব ছড়াচ্ছে বুঝে না বুঝে। সমাজ মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনী নিয়ে অনভিপ্রেত চর্চা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্নের শামিল। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে সশস্ত্র বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম সত্য-মিথ্যা বিষোদ্গার করে রীতিমতো তর্কযুদ্ধ অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য এবং অনভিপ্রেত। এসব তর্কযুদ্ধ কখনোই দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এ ধরনের বিতর্ক আমাদের জাতীয় ঐক্য শুধু বিনষ্ট করবে না, আমাদের সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে ফেলবে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী একটি পেশাদার চৌকস বাহিনী হিসেবে সারা বিশ্বে সমাদৃত, পরিচিত।
এই তো কদিন আগে অক্টোবরে সেন্ট্রাল আফ্রিকার বিদ্রোহী দমনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডাররা গেলেন। সেখানে তারা এক অসাধারণ অভিযানের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেন্ট্রাল আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পর সেখানে সফরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তিনি উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করা হচ্ছে আফ্রিকাজুড়ে। শুধু সেন্ট্রাল আফ্রিকা নয়, সিয়েরা লিওন, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অবদান সবাই গভীর আস্থার সঙ্গে স্বীকার করে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষায় আস্থার প্রতীক। এ কারণেই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ করছে। এটি আমাদের জন্য এক বিরাট অর্জন। এটি শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনীর সাফল্য নয়, এটি পুরো বাংলাদেশের গৌরব। এ গৌরবকে আমাদের সব সময় স্মরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সমস্ত দুর্যোগ, দুর্বিপাক এবং রাষ্ট্রীয় সংকটে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সব সময় জনগণের পক্ষে, শান্তির পক্ষে কাজ করেছে। ইতিহাস তা-ই বলে। আমরা যদি জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থান পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব সেখানেও সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। সশস্ত্র বাহিনী নিরীহ জনসাধারণের প্রতিপক্ষ হতে চায়নি। তারা জনগণকে অস্ত্র দিয়ে দমন করতে চায়নি।
সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর এখন নানা রকম ‘ব্লেম গেম’ শুরু হয়েছে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার গভীর ষড়যন্ত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজ মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে মনগড়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বিবিসিতে একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে কিছু অযাচিত, অনভিপ্রেত এবং তাঁর দায়িত্বের বাইরে কথা বলেছেন। এ বক্তব্যগুলো কখনোই কাম্য নয়, কাঙ্ক্ষিত নয়। ভলকার তুর্ক তাঁর ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়াটাকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছেন না। তিনি কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কথা বলছেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু ৭ মার্চ বিবিসির ‘হার্ডটক’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী একটি ‘চেইন অব কমান্ড’-এর মধ্যে চলে। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারও একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হন।
তাঁদের দায়িত্ব হলো বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য প্রচার, জনমত সৃষ্টি এবং মতামত ব্যক্ত করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা দেখছি মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা রকম ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে গাজার গণহত্যার পর মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের পক্ষপাতিত্ব ও নমনীয় নীতি সারা বিশ্বে সমালোচিত হয়েছে। সেসব বাস্তবতা মাথায় না নিয়ে ভলকার তুর্ক কেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আগ বাড়িয়ে অযাচিত কথা বলতে গেলেন সেটি একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। এমনিতেই বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের ওপর মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন মহল এর গ্রহণযোগ্যতা, তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত হয়েছে কি না তা নিয়ে বড় বিতর্ক এখনো চলমান। এই প্রথম জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক উত্থাপিত হলো, এমনটি নয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের বহু রিপোর্টই খি ত, পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিতর্কিত হিসেবে সমালোচিত। সে বিষয়ে মনোযোগী না হয়ে ভলকার তুর্ক কেন সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন সেটি ভেবে দেখা দরকার। কারণ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এটি এখতিয়ারভুক্ত বিষয় নয়। ভলকার তুর্ক হার্ডটকে যেটি বলেছেন সেটি আরও যদি খোলাসা করে বলতেন, তাহলে হয়তো এ বিতর্ক হতো না। তিনি যদি বলতেন সুনির্দিষ্টভাবে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর কাকে, কী সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, তাহলে প্রশ্ন উঠত না। জাতিসংঘের সঙ্গে একটি সদস্য রাষ্ট্রের যোগাযোগের ধরন সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা জানেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি এ ধরনের সতর্কবার্তা দিতে পারে না, দেয়ও না। জাতিসংঘের এভাবে সতর্কবার্তা দেওয়ার কোনো পদ্ধতিও নেই। তিনি যদি কোনো সতর্কবার্তা দেন, তাহলে সেটি হয়তো বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারকে অথবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন। সে বিষয়টি স্পষ্ট না করে তাঁর এ বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে।