মিথ্যা তথ্যে পাসপোর্ট কর্মকর্তার ৪ ‘পাসপোর্ট’, সই করেন নিজেই
জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া এনওসি ব্যবহার ও বারবার পেশা পরিবর্তনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইচ্ছেমতো নিজ নামে ৪টি পাসপোর্ট বানিয়েছেন উত্তরা ই-পাসপোর্ট পার্সোনাইলেজশন কমপ্লেক্স শাখার উপ-পরিচালক মাসুম হাসান। এমন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বৃহস্পতিবার তাকে আটক করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর (ডিআইপি)।
ডিআইপির মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সম্প্রতি উত্তরা ই-পাসপোর্ট পার্সোনাইলেজশন কমপ্লেক্স শাখার উপ-পরিচালক মাসুম হাসানের বিরুদ্ধে ‘বহুরূপী পাসপোর্ট’ বানানোর অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচিত হয়। এরপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি থানার শঙ্করপাশা গ্রামের এম এম হাসানের ছেলে মাসুম হাসান ২০০৭ সালের ৮ জুলাই যোগ দেন পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রথম পোস্টিং হয় হবিগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। ২ বছর পর বদলি হন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে। ২০১২ সালে বদলি হন যশোরে। সেখান থেকে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতিসহ পোস্টিং পান ময়মনসিংহ কার্যালয়ে। সেখান থেকে রংপুর, পরে ফের ময়মনসিংহ। ২০১৫ সালে ঢাকা বিভাগীয় অফিসে। ২০১৮ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাসপোর্ট অফিসে। ২০১৯ সালে যান ফরিদপুর আঞ্চলিক অফিসে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।
জানা গেছে, মাসুম হাসান ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এনওসি’র ভিত্তিতে প্রথম অফিসিয়াল পাসপোর্ট (ওসি৪০০৬৪৪০) গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট সরকারি চাকরির পরিবর্তে পেশা ‘আদার্স (অন্যান্য)’ উল্লেখ করে এনওসি’র ভিত্তিতে সাধারণ পাসপোর্ট (বিএল০৭১২৩১৮) গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সাধারণ পাসপোর্টের পরিবর্তে পেশা সরকারি চাকরি উল্লেখ করে আবারও ‘জিও’র ভিত্তিতে একটি অফিসিয়াল পাসপোর্ট (ওসি২২৬২৬১৫) গ্রহণ করেন। এই পাসপোর্টটির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময় তিনি ফরিদপুরে কর্মরত ছিলেন। এই পাসপোর্ট করার সময় মাসুম হাসান নিজের আবেদন নিজেই গ্রহণ করেন এবং নিজের পাসপোর্টে নিজেই সই করেন।
আগের অফিসিয়াল পাসপোর্টের মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে থাকাকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অফিসিয়াল পাসপোর্টের পরিবর্তে পেশা সরকারি চাকরির পরিবর্তে ‘পারমানেন্ট অফিসার বা স্টাফ অব অটোনমাস অরগানাইজেশন’ উল্লেখ করে আরেকটি সাধারণ পাসপোর্ট (বিওয়াই০৭৫৩৩৯৫) গ্রহণ করেন। এই পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যে ‘এনওসি’ ব্যবহার করেছেন, সেটা ২০১৬ সালে ইস্যুকৃত। ঐ এনওসি ইস্যুর তারিখ সংশোধন করে হাতে লিখে ২০১৬-কে ২০১৮ করেছেন, যা জালিয়াতির শামিল।
এছাড়া তার এই আবেদনটি প্রক্রিয়াকরণে পূর্ববর্তী পাসপোর্ট লোকাল সার্ভারে ‘ওসি২২৬২৬১৫’ উল্লেখ থাকলেও সেন্ট্রাল সার্ভারে নম্বরটি পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, তিনি অ্যাপ্রুভাল মডিউলের ডিসিএম থেকে আগের অফিসিয়াল পাসপোর্ট নম্বর ওসি২২৬২৬১৫ পরিবর্তন করে তারও পূর্বের সাধারণ পাসপোর্ট নম্বর বিএল০৭১২৩১৮ ব্যবহার করেছেন, যা তথ্য বিকৃতি এবং তথ্য গোপনের শামিল।
মাসুম হাসান সর্বশেষ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, চাঁদগাঁওয়ে থাকাকালীন ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরি উল্লেখ করে এনওসি’র ভিত্তিতে নিজেই নিজের সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ ও অনুমোদন করে একটি সাধারণ ই-পাসপোর্ট (এ০৪৫৯৭৯৩৩) গ্রহণ করেন। সরকারি কর্মচারীদের অফিসিয়াল পাসপোর্টের পরিবর্তে সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণের নির্দেশনা থাকলেও তিনি তা অনুসরণ করেননি। বরং তিনি অসদুপায়ে একাধিক পাসপোর্ট নিয়েছেন।
জানা গেছে, আমেরিকায় অবস্থান করা স্ত্রী-সন্তানদের কাছে যেতেই বারবার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন মাসুম হাসান। একজন পাসপোর্ট কর্মকর্তার এমন কীর্তি ফাঁস হওয়ায় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। গত ২২ নভেম্বর ডিআইপির ডিজি মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেছিলেন। এরপর ৫ ডিসেম্বর আটক করা হয় ত্তরা ই-পাসপোর্ট পার্সোনাইলেজশন কমপ্লেক্স শাখার উপ-পরিচালক মাসুম হাসানকে।